তামাকপণ্যের ব্যবহার : নজর কম মন্ত্রণালয়গুলোর
ফখরুল ইসলাম, ঢাকা
- তামাকজাত পণ্য ব্যবহারের কারণে বছরে ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ মারা যায়।
- দেশে একজন ধূমপায়ী মাসে সিগারেট বাবদ খরচ করে ১ হাজার ৭৭ টাকা।
- সিগারেটের প্যাকেটের গায়ের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা ৫০%।
তামাকজাত পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারার সুযোগ রয়েছে। যেমন বিড়ি-সিগারেটসহ তামাকজাত পণ্যের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করা হলে একদিকে এগুলোর ব্যবহার কমবে, অন্যদিকে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজেট আসার আগে থেকেই এই প্রস্তুতি নিতে হবে। আর সেটি শুরু করার এখনই উপযুক্ত সময়।
কিন্তু বিষয়টির সঙ্গে জড়িত সরকারের কৃষি, শিল্প, অর্থ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তেমন কোনো ভূমিকা পালন করছে না। অর্থাৎ সরকার সুযোগটি নিচ্ছে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে দক্ষিণ এশীয় স্পিকারস সম্মেলনে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেন। বাংলাদেশ ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশও।
তামাকবিরোধী বেসরকারি সংস্থা প্রগতির জন্য জ্ঞান (প্রজ্ঞা) বলছে, প্যাকেটের গায়ের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ করতে হবে। সেই সঙ্গে বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকপণ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে তামাকপণ্যের বিক্রি বন্ধ, খুচরা (শলাকা) তামাকপণ্য বিক্রি নিষিদ্ধ এবং তামাক কোম্পানির কাছ থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুদান নেওয়া বন্ধ করতে হবে।
কোভিড-১৯ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার বেশি করেছেন, এমন কোভিড রোগীরা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। তবে আমাদের কাছে নতুন কিছু পর্যবেক্ষণ এসেছে। সে অনুযায়ী কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
মো. আবদুল মান্নান, স্বাস্থ্যসচিব
কৃষি মন্ত্রণালয় চুপচাপ
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে তামাকচাষি বাড়ছে। বর্তমানে ২ লাখের বেশি তামাকচাষি রয়েছেন, যা ১০ বছর আগের তুলনায় দ্বিগুণ। ১০ বছরে তামাক উৎপাদনও দ্বিগুণ বেড়েছে। রংপুর, কুষ্টিয়া ও পার্বত্য চট্টগ্রাম হচ্ছে তামাক উৎপাদনকারী প্রধান জেলা।
কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের দুই শিক্ষক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন ও মো. মাহবুবুর রহমান কুষ্টিয়ায় তামাক চাষের ওপর গবেষণা করে বলেছেন, জেলাটির দৌলতপুর ও মিরপুর উপজেলার কৃষিজমির ৯১ শতাংশেই তামাক চাষ হয়। তামাক চাষে সার বেশি লাগে, মাটির গুণাগুণ নষ্ট হয়, পরিবেশ দূষিত হয় এবং স্বাস্থ্যগত ক্ষতি হয়। অথচ কৃষি মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কিছুই করছে না।
কুষ্টিয়ার দুই উপজেলায় তামাক উৎপাদনের তথ্য জেনে বিস্মিত কৃষিসচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি খোঁজ নেবেন।
তামাকপণ্যের ব্যবহারকারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি এমনিতেই বেশি। কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে এ ঝুঁকি আরও বেশি।
সিগারেটও নিত্যপণ্য!
দেশের সিগারেট কোম্পানি ও বিড়ি কারখানাগুলো শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতায়। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি), ঢাকা টোব্যাকো, নাসির টোব্যাকো, আবুল খায়ের টোব্যাকো, ভরসা টোব্যাকো, আকিজ টোব্যাকো হচ্ছে প্রধান কোম্পানি। সিগারেটের বাজারের ৯৮ শতাংশ বিএটি, আকিজ ও আবুল খায়েরের দখলে।
প্রজ্ঞা বলছে, চার শ্রেণির সিগারেটের মধ্যে নিম্নমানের সিগারেটই উৎপাদন হচ্ছে ৭৯ শতাংশ। বাকি ২১ শতাংশ হচ্ছে অতি উচ্চ, উচ্চ ও মধ্যম—এই তিন শ্রেণির। আর গড়ে দেশের প্রায় সব উপজেলাতেই একাধিক বিড়ি কারখানা আছে, অনেক কারখানার মালিক আবার সাংসদও।
কোভিড-১৯ চলাকালীন দুটি বড় কোম্পানি শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে এমন একটি অনুমতিপত্র নিয়েছে, যেটিতে বলা হয়েছে সিগারেট একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য।
শিল্পসচিব কে এম আলী আজম অসুস্থ থাকায় কোনো কথা বলতে চাননি।
তামাকপণ্য নিয়ে সব পক্ষের সঙ্গে বসে এখনই কিছু করতে হবে। আমরা জানি, কিছু সাংসদ বিড়ি কারখানার মালিক, আবার বিএটির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার পর্ষদে সরকারের সচিবেরাও রয়েছেন।
আবদুল মজিদ, সাবেক চেয়ারম্যান,এনবিআর
অনুদানও নেয় সরকারি সংস্থা
দেশের একজন ধূমপায়ীর মাসে সিগারেট বাবদ খরচ হয় ১ হাজার ৭৭ টাকা। অথচ শিক্ষা বাবদ একটি পরিবারের মাসিক খরচ ৮৩৫ টাকা ও চিকিৎসার জন্য ৭০০ টাকা। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভের (গ্যাটস) ২০১৭ সালের জরিপ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের পৌনে চার কোটি মানুষ তামাক ব্যবহার করে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীন একটি অধিদপ্তর তাদের অনুষ্ঠান করেছে বিএটির অনুদানে—এমন উদাহরণও আছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘তামাকপণ্য নিয়ে সব পক্ষের সঙ্গে বসে এখনই কিছু করতে হবে। আমরা জানি, কিছু সাংসদ বিড়ি কারখানার মালিক, আবার বিএটির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার পর্ষদে সরকারের সচিবেরাও রয়েছেন। তারপরও প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাটি এখানে বড়। ফলে একটি গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপের কাছে নত হওয়া যাবে না।’
তামাকে বছরে সোয়া লাখ মৃত্যু
তামাকজাত পণ্য ব্যবহারের কারণে বছরে ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ মারা যায় এবং তামাকজাত পণ্যের প্রভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকারকে খরচ করতে হয় ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। আইনে নিষেধাজ্ঞা থাকায় বিজ্ঞাপন দিতে পারে না, ফলে বড় কোম্পানিগুলো বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছে। অথচ এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসচিব মো. আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোভিড-১৯ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার বেশি করেছেন, এমন কোভিড রোগীরা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। তবে আমাদের কাছে নতুন কিছু পর্যবেক্ষণ এসেছে। সে অনুযায়ী কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’
News Source: Prothomalo, 28 November 2020